ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা বিদাত কেন?

প্রশ্নঃ আমি ছোটকাল থেকেই জেনে এসেছি আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) আরবি মাসের ১২-ই রবিউল আওয়াল জন্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু সম্প্রতি ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে,  তিনি কোন মাসের কত তারিখে জন্ম গ্রহণ করেন এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাহলে যারা মিলাদুন্নবী বা নবীর জন্ম বার্ষিকি উদযাপন করেন তারা কিসের ভিত্তিতে করেন এবং কেন করেন? এই ভাবে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা জায়েজ কিনা বিস্তারিত জানতে চাই। জানালে উপকৃত হব।

উত্তরঃ শুধু আপনি না আমিও ছোটকাল থেকে এটাই জেনে আসছি যে, মুহাম্মদ (সাঃ) ১২ ই রবিউল আওয়াল জন্ম গ্রহণ করেন। মূলত এইটা কোরান বা হাদিস থেকে প্রমাণিত কোন মাস বা তারিখ নয়। বরং এইটা ঐতিহাসিকদের অনেক গুলো মতের মধ্যে একটি মত। নবীজি (সাঃ) কোন মাসের কত তারিখে জন্ম গ্রহণ করেন এই ব্যপারে সাহাবীগণ কখনো তাকে জিজ্ঞাসা করেনি। কারণ তাদের প্রয়োজনও পড়েনি। স্পষ্ট ভাবে বলা যায় শুধু মাত্র উত্তম তিন যুগ নয় ইমাম আবূ হানিফা, সাফেঈ, মালেক ও হাম্বলি (রঃ)। তাদের যুগেও নবীজি (সাঃ) এর জন্ম তারিখ বা সন নিয়ে আলোচনা হয়নি। তাদের অনেক পরে সিরাত গ্রন্থের লেখকগণ এই বিষয়ে লেখা লেখি করেন। তাতে এইটা নিয়ে মতভেদের সৃষ্টি হয়।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুম তার লেখা সিরাত গ্রন্থে কোন সূত্রের উল্লেখ ছাড়াই ১২ ই রবিউল আওয়াল মতটি উল্লেখ করেন। যেহেতু তার লেখা বইটি বিশ্বব্যাপি অধিক গ্রহণ যোগ্য হয়। তাই তার এই মতটি পরবর্তী লেখকগণ তাদের লেখায় সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করেন।
যাইহোক, মুহাম্মদ (সাঃ) জন্ম তারিখ নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট দলিল না থাকায় এইটা অনেক মতের সৃষ্টি হয়। এখান থেকে এই কথা নিশ্চিত যে, যারা বলে মিলাদুন্নবী সাহাবীরা উদযাপন করেছেন তারা চরম মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে। এই জন্য তারা অনেক জাল হাদিসও বানিয়েছেন। আল্লাহ এইসব লোকের মিথ্যাচার ও বাড়াবাড়ি  থেকে আমাদের রক্ষা করুক।
এবার আপনার প্রশ্নের জবাবে আসা যাক। আপনি একই সাথে তিনটি বিষয় নিয়ে জানতে চেয়েছেন। তারা মিলাদুন্নবী কিসের ভিত্তিতে করেন,  কেন করেন এবং করাটা জায়েজ কিনা?
Miladunnabi / মিলাদুন্নবী



ইসলামের প্রচার প্রসারের সাথে সাথেই বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ ইসলামে প্রবেশ করে। কিন্তু তাদের জ্ঞান স্বল্পতা ও পূর্বে অনুসৃত ধর্মের নিয়ম নীতি তাদেরকে ইসলামে সম্পূর্নভাবে প্রবেশ করতে দেয়নি। মূলত এই দুই কারণেই মুসলিম সমাজে কুসংস্কার ও অন্য ধর্মের নিয়ম নীতি ঢুকে পড়ে। মিলাদুন্নবী তারই একটি অংশ এবং এটাই এর ভিত্তি। যারা বড়দিন উদযাপন করত কিংবা জন্ম অস্টমী উদযাপন করত তাদের অনেকেই মুসলমান হওয়ার পর মিলাদুন্নবী উদযাপন করেছিল। যেহেতু তারা আগে থেকেই জন্ম বার্ষিকি উদযাপনে অভ্যাস্ত ছিল। তাই তারা মুসলমান হওয়ার পরও এই কাজে জড়িয়ে পড়ে।
অনেকেই হয়তো এই ধারণা নিয়েই মিলাদুন্নবী উদযাপন করেন যে, খ্রিষ্টানরা যদি তাদের নবীর জন্ম বার্ষিকি উদযাপন করতে পারে, হিন্দুরা যদি তাদের ধর্মের প্রবর্তকের জন্ম বার্ষিকি উদযাপন করতে পারে আমরা কেন আমাদের নবীর জন্ম বার্ষিকি উদযাপন করতে পারবনা। মূলত যাদের মধ্যে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান তারাই মিলাদুন্নবী উদযাপন করে থাকে। এটা যে তাদের কত বড় মূর্খতা তা নিজেরাই ভুলে গেছে। এই ধরনের আবেগি চিন্তাধারা যে মানুষকে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্গণের দিকে নিয়ে যায় তা বর্তমান সময়ে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা দেখলেই বুঝা যায়।
আজকের যুগে যারা মিলাদুন্নবী উদযাপন করে তারা জানে যে, ইহা সাহাবীগণ উদযাপন করেছে। তারা যদি জানত সাহাবীগণ ইহা উদযাপন করা তো দূরে থাক নবীজি (সাঃ) কোন মাসের কত তারিখে জন্মেছেন তাও জানতেন না। তাহলে, তারা এই বিষয়ে আমাদের সাথে তর্কও করত না এবং মিলাদুন্নবীও উদযাপন করতেন না। মূলত তাদেরকে জাল হাদিস ও মিথ্যা ওয়াজ শোনিয়ে এক শ্রেণীর দুনিয়া পূজারী মানুষ এইসব করাচ্ছে। আল্লাহ তাদের সকল প্রকার বিদাত ও কুসংস্কার থেকে হেফাজত করুক।
এইবার আপনার তৃতীয় প্রশ্ন হলো মিলাদুন্নবী উদযাপন করা জায়েজ কিনা?
ইতিমধ্যেই আপনি জানতে পারছেন যে, ইসলামে জন্ম বার্ষিকি উদযাপনের কোন বিধান ছিলনা বরং ইহা অন্যান্য ধর্মের অনুসৃত একটি কাজ। তাই আপনাকে স্পষ্ট ভাবে বলে দিতে চাই ইহা উদযাপন করা কিছুতেই জায়েজ হতে পারেনা। ইসলামে শরীয়তের ভিতর নতুন কোন আমল চালু করা হারাম। এই দ্বীন পরিপূর্ণ। তাতে কোন কিছু যোগ বিয়োগ করা হারাম। নিচে কোরান হাদিস থেকে কিছু দলিল দিলাম। আশা করি চিন্তা করবেন।
আল্লাহ পাক তাঁর কিতাব কুরআন মজীদে এরশাদ করেছেনঃ 
ﺇِﻥَّ ﺍﻟﺪِّﻳﻦَ ﻋِﻨْﺪَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺍﻟْﺈِﺳْﻼﻡُ
‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীম দ্বীন হলো ইসলাম।’ (আল ইমরান, ৩ : ১৯)
ﻭَﻣَﻦْ ﻳَﺒْﺘَﻎِ ﻏَﻴْﺮَ ﺍﻟْﺈِﺳْﻼﻡِ ﺩِﻳﻨًﺎ ﻓَﻠَﻦْ ﻳُﻘْﺒَﻞَ ﻣِﻨْﻪُ
‘কেউ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন চায় তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।’ (আল ইমরান, ৩ : ৮৫)
ইসলাম পরিপূর্ণ দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা ইসলাম পরিপূর্ণ দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ পাক কুরআন মাজীদে এরশাদ করেন :
ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﺃَﻛْﻤَﻠْﺖُ ﻟَﻜُﻢْ ﺩِﻳﻨَﻜُﻢْ ﻭَﺃَﺗْﻤَﻤْﺖُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻧِﻌْﻤَﺘِﻲ ﻭَﺭَﺿِﻴﺖُ ﻟَﻜُﻢُ
ﺍﻟْﺈِﺳْﻼﻡَ ﺩِﻳﻨ
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম। আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর পূর্ণতা দিলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (মায়েদা, ৫ : ৩)
রাসূল (সা) বলেন,
ﺍﻥ ﺃﺻﺪﻕ ﺍﻟﺤﺪﻳﺶ ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﺃﺣﺴﻦ ﺍﻟﻬﺪﻱ ﻫﺪﻱ
ﻣﺤﻤﺪ ﻭﺷﺮ ﺍﻷ ﻣﻮﺭ ﻣﺤﺪ ﺷﺎ ﺗﻬﺎ ﻭﻛﻞ ﻣﺤﺪ ﺷﺔ ﺑﺪﻋﺔ
ﻭﻛﻞ ﺑﺪﻋﺔ ﺿﻼ ﻟﺔ ﻭﻛﻞ ﺿﻼ ﻟﺔ ﻓﻲ ﺍﻟﻨﺎﺭ
সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম আদর্শ মুহম্মদের (সা) আদর্শ, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো বিদাআত। আর প্রত্যেক বিদাআতই গোমরাহী তথা পথভ্রষ্টতা (মুসলিম)।
তিনি আরও বলেন,
ﻣﻦ ﻋﻤﻞ ﻋﻤﻼ ﻟﻴﺲ ﻋﻠﻴﻪ ﺃﻣﺮ ﻧﺎ ﻓﻬﻮ ﺭﺩ
আমাদের কর্ম নয় এমন কোনো কর্ম যদি কোনো মানুষ করে তাহলে তার কর্ম প্রত্যাখ্যাত হবে (বুখারী)।
কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে কোন কওমের সাথে সামঞ্জস্য রাখল, সে তাদের
অন্তর্ভুক্ত”। [আবু দাউদঃ ৩৫১৪, আহমদঃ ৫১০৬), ইকতিদাউস সিরাতুল মুস্তাকিমঃ ১/২৪০, ফাতহুল বারিঃ ১১/৪৪৩]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন,
ﺍﻥ ﻣﻦ ﺃﺑﻐﺾ ﺍﻻﻣﻮﺭ ﺇﻟﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﺍﻟﺒﺪﻉ
"নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত বিষয় হলো বিদাত"
সাহাবী ইবনে মাসূদ (রা) বলেন,
ﺍﺗﺒﻌﻮﺍ ﻭﻻ ﺗﺒﺘﺪ ﻋﻮﺍ ﻓﻘﺪ ﻛﻔﻴﺘﻢ
"তোমরা অনুসরণ কর, উদ্ভাবন করোনা। দ্বীনের মধ্যে যা আছে তাই তোমাদের জন্য যতেষ্ট"।
কোরান, হাদীস ও সাহাবীদের বক্তব্য থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অপ্রয়োজনে সুন্নাহ
বহির্ভূত কোনো কাজ করা বিদাত এবং হারাম।

আবুবকর সিদ্দিক
২১/১১/২০১৮ 
Tag: milad, miladunnobi, Miladunnabi, Eid, Bidath, sunnah মিলাদ, ঈদ, বিদাত, বিদাহ, সুন্নাহ

Comments

Popular posts from this blog

Application for permission to visit National Museum.

মিলাদুন্নবী ও সূরা আহযাবের 56 নং আয়াত:

ইবাদতে মাইকের ব্যবহার নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তি নিরসন (প্রথম পর্ব)

রাসূল (সা) প্রতি সোমবারে রোজা রাখতেন কেন?

সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (রা) এর সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ