প্রশ্নঃ আল্লাহর ধনভাণ্ডার কি? এই ধনভাণ্ডার কি আল্লাহ তার রাসূলকে দিয়েছিল?

প্রশ্নঃ আল্লাহর ধনভাণ্ডার কি? এই ধনভাণ্ডার কি 
আল্লাহ তার রাসূলকে দিয়েছিল? 
ধনভাণ্ডার, treasures
ধনভাণ্ডার, treasure,


উত্তরঃ প্রথমেই জেনে নিই ধনভাণ্ডার অর্থ। ধনভাণ্ডার শব্দটি ধন ও ভান্ডার এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত একটি শব্দ। ধনের বাংলা সরল অর্থ সম্পদ। আর ভান্ডারের বাংলা সরল অর্থ কোষাগার। ধনভান্ডারের বাংলা সরল অর্থ অতিপ্রয়োজনীয় মূল্যবান সম্পদের জমাকৃত ভান্ডার বা গচ্ছিত বা গুপ্ত ভান্ডার।
ধনভাণ্ডার আরবিতে (كنز) আর ইংরেজিতে (Treasure)
এই হলো দুনিয়ার মানুষের জন্য প্রচলিত ধনভান্ডারের অর্থ। যা একদিন শেষ হয়ে যায়।
এইবার জেনে নিই আল্লাহর ধনভাণ্ডার কি। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় ধনভাণ্ডার শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
কুরানে كنز শব্দের পাশাপাশি خَزَآئِنُ শব্দও ব্যবহার হয়েছে। উভয় অর্থ ধনভাণ্ডার বা গচ্ছিত সম্পদ, গুপ্ত সম্পদকে বুঝানো হয়েছে। 
আল্লাহর ধনভাণ্ডার বলতে দুনিয়া ও আখিরাতের অপুরন্ত নাছ নিয়ামতকে বুঝানো হয়, যা কেবল আল্লাহর কাছেই সংরক্ষিত। যে নেয়ামত কখনোই শেষ হবার নয়।
আল্লাহ বলেন, 
وَ لِلّٰہِ خَزَآئِنُ  السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنَّ  الۡمُنٰفِقِیۡنَ  لَا  یَفۡقَہُوۡنَ 

আর আসমান ও জমিনের ধনভাণ্ডার তো আল্লাহরই। কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝেনা। (আলকুরানঃ ৬৩/০৭)
اَمۡ عِنۡدَہُمۡ  خَزَآئِنُ رَحۡمَۃِ  رَبِّکَ الۡعَزِیۡزِ  الۡوَہَّابِ
তাদের কাছে কি তোমার রবের রহমতের ভান্ডার রয়েছে যিনি মহাপরাক্রমশালী, অসীম দাতা। (আলকোরানঃ ৩৮/০৯)
রিযিক হচ্ছে আল্লাহর ধনভাণ্ডারের কিছু অংশ। এই রিযিক আল্লাহ দেন তার অপোরন্ত ধনভাণ্ডার থেকে। সৃষ্টি জগতের জন্য তা তিনি পরিমিতভাবে নাযিল করেন। তিনিই এই রিযিকের নিয়ন্ত্রক।
আল্লাহ বলেন, 
لَہٗ  مَقَالِیۡدُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ  وَ  یَقۡدِرُ ؕ اِنَّہٗ  بِکُلِّ  شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ
আসমানসমূহ ও যমীনের (ধনভান্ডারের) চাবি তাঁর কাছে; যার জন্য ইচ্ছা তিনি রিয্ক প্রশস্ত করেন এবং নিয়ন্ত্রিত করেন; নিশ্চয় তিনি সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞাত। (আলকোরানঃ ৪২/১২)
اَمَّنۡ ہٰذَا الَّذِیۡ یَرۡزُقُکُمۡ  اِنۡ  اَمۡسَکَ رِزۡقَہٗ ۚ بَلۡ لَّجُّوۡا فِیۡ عُتُوٍّ  وَّ نُفُوۡرٍ
অথবা এমন কে আছে, যে তোমাদেরকে রিয্ক দান করবে যদি আল্লাহ তাঁর রিয্ক বন্ধ করে দেন? বরং তারা অহমিকা ও অনীহায় নিমজ্জিত হয়ে আছে। (আলকোরানঃ ৬৭/২১)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে ধনভান্ডারের অর্থ  ও আল্লাহর ধনভাণ্ডার কি তা জানলাম। এবার আসি আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে। 
আপনি জিজ্ঞাসা করেছেন, আল্লাহর ধনভাণ্ডার কি নবী মুহাম্মাদ সাঃ কে দেয়া হয়েছিল? 
প্রথমেই আমার সোজা উত্তর হলোঃ না, আল্লাহ তার ধনভাণ্ডার কাউকে দিয়ে দেননি। এইটা কাউকে আল্লাহ দিবেনও না। তবে আল্লাহ তার ধনভাণ্ডার হতে কিছু কিছু দেন। যা আমরা গচ্ছিত রাখি। যেমন আমাদের জায়গা জমি, টাকা পয়শা, রিযিক, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি আল্লাহ তার ধনভাণ্ডার হতে আমাদের দেন।
কিন্তু আল্লাহ তার ধনভাণ্ডারের চাবি বা করতৃত্ব কাউকে দিয়ে দেননা। এইটা হলে তো মানুষ আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে গিয়ে যাকে দিছে তাকেই রব হিসেবে গ্রহণ করবে, এবং শিরকে নিমজ্জিত হবে।
বর্তমান সময়ে কিছু নামধারী মুসলিম বলে থাকে যে, আল্লাহর রাসূল সাঃ কে আল্লাহ তার ধনভান্ডার দিয়ে দিয়েছেন। (নাউযুবিল্লাহ)। এইটা মুশরিকদের একটি ভ্রান্ত ধারণা। যে ধারণার কারণে তারা নবীদের অস্বীকার করত। নবীগণ যখন তাদের কওমের কাছে নিজেদের নবুওয়তের দাবি করত। তখন তারা এই বলে তাদের অস্বীকার করত যে, নবী হবেন এমন কেউ যার কাছে আল্লাহর ধনভাণ্ডার থাকবে। অথচ তুমি আমাদের অনেকের চেয়ে গরীব। তুমি যদি নবী হও তবে তুমার অটল সম্পদ নেই কেন? এইভাবেই তারা তাদের উপর প্রেরিত প্রত্যেক নবীকে অস্বীকার করত। 
কোরানে আল্লাহ তাদের এইধরনের একটি বক্তব্য তুলে ধরেনঃ
اَوۡ یُلۡقٰۤی اِلَیۡہِ کَنۡزٌ اَوۡ تَکُوۡنُ لَہٗ جَنَّۃٌ یَّاۡکُلُ مِنۡہَا ؕ وَ قَالَ الظّٰلِمُوۡنَ  اِنۡ تَتَّبِعُوۡنَ   اِلَّا  رَجُلًا  مَّسۡحُوۡرًا
অথবা তাকে ধনভান্ডার ঢেলে দেয়া হয় না কেন অথবা তার জন্য একটি বাগান হয় না কেন যা থেকে সে খেতে পারে?’ যালিমরা বলে, ‘তোমরা শুধু এক যাদুগ্রস্ত লোকের অনুসরণ করছ’। (আলকোরানঃ ২৫/০৮)
এই হলো দুনিয়ায় প্রেরিত সকল নবীদের কাফেরদের অস্বীকার করার একটি ধরন।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ কেও কাফের মুশরিকরা এই ধরনের প্রশ্ন করত। তারা মনে করত যে, মুহাম্মদ যেহেতু নিজেকে নবী দাবি করছে, সেহেতু তার নিকট অবশ্যই আল্লাহর ধনভাণ্ডার আছে। তিনি গায়েব জানেন, এবং তিনি একজন ফেরেস্থায় হবেন।
এইসবের জবাবে আল্লাহ বলেন, 
قُلۡ  لَّاۤ  اَقُوۡلُ لَکُمۡ عِنۡدِیۡ خَزَآئِنُ اللّٰہِ وَ لَاۤ  اَعۡلَمُ الۡغَیۡبَ وَ لَاۤ  اَقُوۡلُ لَکُمۡ  اِنِّیۡ مَلَکٌ ۚ اِنۡ  اَتَّبِعُ  اِلَّا مَا یُوۡحٰۤی  اِلَیَّ ؕ قُلۡ ہَلۡ  یَسۡتَوِی الۡاَعۡمٰی وَ الۡبَصِیۡرُ ؕ اَفَلَا  تَتَفَکَّرُوۡنَ
বল, ‘তোমাদেরকে আমি বলি না, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডারসমূহ রয়েছে আর না আমি গায়েব জানি, আর না  তোমাদেরকে বলি, নিশ্চয় আমি ফেরেশতা। আমি কেবল তাই অনুসরণ করি যা আমার কাছে ওহী প্রেরণ করা হয়’। বল, ‘অন্ধ আর চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? অতএব তোমরা কি চিন্তা করবে না’? (আলকোরানঃ ৬/৫০) উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এই কথা সুস্পষ্ট যে কাফের মুশরিকদের নবীজি সাঃ এই কথা বলেনি যে, তার নিকট আল্লাহর ধনভাণ্ডার রয়েছে। তারা যা বলে এইসব তাদের মিথ্যা ধারণা। তিনিতো কেবল তার উপর নাযিল হওয়া ওহীর অনুসরণ করে।
অনুরূপ ধারণা হযরত হূত (আঃ) ব্যপারেও তার কওমরা করত। তাদের উত্তরে হযরত হূত (আঃ) অনুরূপ জবাবই দিয়েছিল। দেখুন, সূরা হুদের ৩১ নং আয়াত।
আশা করি উপরোক্ত কুরআন ভিত্তিক আমার আলোচনা থেকে এই কথা সুস্পষ্ট যে হয়েছে যে, আল্লাহ তার ধনভান্ডারের করতৃত্ব কাউকে দিয়ে দেননি, এমনকি আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাঃ কেও না। সুতরাং যেখানে ধনভাণ্ডার রাসূল সাঃ কে দেননি, সেখানে পীর আওলিয়াগন মানুষদের যা ইচ্ছা দিতে পারেন এমন ধারণা সুস্পষ্ট মূরখতা বৈ আর কিছুই নয় (এইটুকু আলোচনায় কারও কোনরকম সন্দেহ থাকলে সূরা আনামের ৫০ নং আয়াতের তাফসির, তাফসিরে জালালাইন দেখতে পারেন।)
সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারা আল্লাহ যে আল্লাহ তার ধনভাণ্ডার নবীজি সাঃ কে দেননি তা প্রমাণিত হওয়ার পরও বর্তমান সময়ের কিছু মুসলিম নামধারী মুশরিক এই কথা বলে বেড়াচ্ছে যে, নবীজি সাঃ কে আল্লাহ তার ধনভাণ্ডার দিয়েছেন। তাদের এই কুরআন বিরোধী চিন্তাধারার মূল কারণ, তারা কুরআন বুঝে পড়েনা, তারা অতি আবেগী এবং তারা হাদিসের অপব্যাখ্যা করে। এই তিনটি কারণই তাদের এই ভ্রান্ত ধারণার মূল কারণ। 
নিচে হাদিসের আলোকে তাদের ভ্রান্ত ধারণার জবাব দিচ্ছি।  আশা করি বুঝার চেষ্টা করবেন। 
প্রথমেই বলে রাখি কুরআনের আয়াত দ্বারা এই কথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর রাসূল সাঃ এই কথা বলেনি যে, তার নিকট আল্লাহর ধনভাণ্ডার রয়েছে। 
সুতারাং এর বিপরীতে কোন হাদিস থাকার সম্ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।
বেশ কিছু হাদিসে আছে রাসূলুল্লাহ সাঃ কে স্বপ্নের মাধ্যমে দুনিয়ার ধনভাণ্ডারের চাবি তার হাতে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসূল তা গ্রহণ করেনি। তিনি সাঃ এই ধনভাণ্ডার ত্যাগ করে দারিদ্রতাকেই গ্রহণ করেছিল। 
কেন তিনি দারিদ্রতাকে গ্রহণ করেছিল তা নিচের হাদিসের ব্যখ্যা থেকে বুঝে নিন, 
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: مَا شَبِعَ آل مُحَمَّد من خبر الشَّعِيرِ يَوْمَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ حَتَّى قُبِضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ . مُتَّفق عَلَيْهِ متفق علیہ ، رواہ البخاری (5416) و مسلم (22 / 2970)، (7445) ۔ (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (সা.) -এর পরিবারবর্গ লাগাতার দু'দিন যবের রুটি খেয়ে পরিতৃপ্ত হননি এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মৃত্যু হয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)
ব্যাখ্যা : রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর পরিবার হলো তার পূতপবিত্র স্ত্রীগণ এবং তাদের খাদিমগণ। যব গমের তুলনায় কম মূল্যমানের, যবের রুটিই যেহেতু পাননি তাহলে গমের রুটির তো প্রশ্নই ওঠে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) দু'দিন একাধারে পেট পুরে খেতে পাননি, একদিন পেটপুরে খেলে অন্যদিনে উপোষ থাকতেন। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তা'আলা জমিনের ধনভাণ্ডারের চাবি তার কাছে পেশ করেছিলেন এবং মক্কার একটি পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করে তার নিকট পেশ করেছিলেন কিন্তু তিনি এ কথা বলে দরিদ্রতাকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন যে, আমি একদিন ক্ষুধার্ত থেকে সবর করব, আরেকদিন খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব। কেননা ঈমান দুই অংশে বিভক্ত, এক অংশ সবরের মধ্যে, অন্য অংশ শুকরিয়ার মধ্যে; যেমন আল্লাহ বলেছেন :
(اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّکُلِّ صَبَّارٍ شَکُوۡرٍ) “নিশ্চয় তাতে উপদেশ রয়েছে প্রত্যেক ধৈর্যশীল এবং কৃতজ্ঞ বান্দাদের জন্য।” (সূরাহ্ ইবরাহীম ১৪ : ৫, লুকমান ৩১ : ৩১, আশ শুআরা- ২৬ : ৩৩)। 

রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর এ অবস্থা মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এমনকি তিনি মৃত্যুর পূর্বে তার বর্মটি এক ইয়াহূদীর কাছে বন্ধক রেখে সামান্য কয়েক সা' যব ধার গ্রহণ করেছিলেন। অনেকে বলে থাকেন রাসূলুল্লাহ (সা.) শেষ জীবনে ধনী হয়ে গিয়েছিলেন। উপযুক্ত হাদীস দ্বারা তাদের এ দাবী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। হ্যা, তাঁর হাতে অনেক সম্পদ এসেছিল কিন্তু সেগুলো তিনি নিজের জন্য সংরক্ষণ করেননি বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সব খরচ করে দিয়েছেন। অবশ্য তিনি সদা সর্বদা অন্তরের ধনী ছিলেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ; ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, হা. ৬৪৫৪; আল কাশিফ ১০ম খণ্ড, ৩৩১১ পৃ.)
হাদিস ও তার ব্যাখ্যা মিশকাতুল মাসাবিহ থেকে সংগৃহীত। দেখুনঃ ৫২৩৭। 
আশা করি এইটুকু আলোচনা জ্ঞানী ও উপদেশ গ্রহণকারী ভাইবোনদের জন্য যথেষ্ট।
❤️ অবশেষে সকল ভালো কাজই আল্লাহর জন্য। 
বিনীতঃ আবুবকর সিদ্দিক। ৫/৫/২০২২

Comments

Popular posts from this blog

Application for permission to visit National Museum.

মিলাদুন্নবী ও সূরা আহযাবের 56 নং আয়াত:

ইবাদতে মাইকের ব্যবহার নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তি নিরসন (প্রথম পর্ব)

রাসূল (সা) প্রতি সোমবারে রোজা রাখতেন কেন?

সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (রা) এর সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ